নাসির উদ্দীন ইউসুফ
সেই কবে ১৯৮২ খৃষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি, ১৩ মাঘের অন্তে তীব্র শীতের সকালে বন্ধু নাট্যকার সেলিম আল দীন ও আমরা তার স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার পিতা-মাতার বসতবাড়ি মানিকগঞ্জের তালুকনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য আজহার বয়াতীর ঐতিহ্যবাহী মেলা দর্শন, ঢাকা থিয়েটারের নাটক সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল নাটক পরিবেশন এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের প্রথম সংগঠন তালুকনগর থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করা।
সেলিম আল দীনের অসাধারণ নাটক কিত্তনখোলা মঞ্চায়ন প্রক্রিয়া কালীন সময়েই ঢাকা থিয়েটার অনুধাবন করে যে তারা নতুন এক নাট্যপথের সন্ধান পেয়েছে, যে পথ মুক্তিযুদ্ধোত্তোর বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে ঔপনিবেশিক রীতির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশজ এক নাট্যরীতির বিশাল দিগন্তে ধাবিত করবে। তরুণ নাট্যকার ও ঢাকা থিয়েটার’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন সে পথের সন্ধান তার নাট্য রচনা ও বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ইঙ্গিত করেছেন। ঢাকায় আমার বাসায় আসাদ, পীযূষ, শিমূল, সেলিম আমি অগুনিত বিনিদ্র রাত্রি যাপন করেছি! আলোচনা ও তর্কে লিপ্ত হয়েছি ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির কৌশল ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। কেননা ঢাকা থিয়েটার বিগত ৮ বছরে যে নাট্যচর্চা করে আসছি তা অবশ্যই স্বাধীন কিন্তু অনেকাংশেই পশ্চিমা থিয়েটার অভিজ্ঞতাজাত। তাই সেলিমের প্রস্তাবনা যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে অর্থাৎ মানুষের সার্বিক মুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তা বুঝতে আমরা সক্ষম! তবে দেশেজ ও নিজস্ব শিল্পরীতি, নাট্যরীতি সম্পর্কিত গবেষণা ও আধুনিক কালে এর প্রয়োগ কৌশল নিয়ে রচনার অভাব এবং শিক্ষা আয়তন নেই। তাই আমাদের ঢাকা থিয়েটার’র অনেকের সংশয়। সেলিম আল দীনের শ্বশুরালয় মানিকগঞ্জের তালুকনগরে, সেখানে প্রতিবছর আজহার বয়াতীর মেলা হয়। সেই মেলায় গাজীরগাণ, পালা, যাত্রা, বিচারগাণ, কবির লড়াই সহ অনেক নাট্যপালা সারারাত ব্যপী পরিবেশিত হয়। সেখানে আমাদের সুযোগ ঘটবে স্বচক্ষে নিজস্ব দেশজ নাট্যাঙ্গিকের সাথে সম্মক পরিচিত হবার। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে পুরানা পল্টনে লাইনের আমার বাসায় এক সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে ঢাকা থিয়েটারও একটি নাট্যপ্রযোজনা সেই মেলায় পরিবেশন করবে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সেলিম আল দীন ‘সয়ফুল মূলত বদিউজ্জামন’ নামে একটি নাটক রচনা করে দিলেন। আমি দ্রুত নাটক মহড়ার কাজ শুরু করি। রাইসুল ইসলাম আসাদ, রফিক মাহমুদ, মোঃ শাহজাহান, এম. মজিদ, কামাল বায়েজীদ, শতদল বড়ুয়া, আমিনুল ইসলাম টিপু, রুমি, শিবলী নোমানী, ইমরুল কায়েস, কাইজার প্রমুখকে সাথে নিয়ে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে নাট্যরূপ তৈরী করি। শিমূল, শাহজাহান ও মজিদকে নিয়ে নাটকের সুর ও সঙ্গীত তৈরী করে। রূপসজ্জার দায়িত্ব দেয়া হয় মোঃ ফারুককে।
১৯৮২ সালের ১০ জানুয়ারি আসাদ, আমি, সেলিম, পারুলসহ আমরা ঢাকা থিয়েটারের জনা কুড়ি সদস্য তালুকনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে পুরানো একটা ভগ্ন বাসে আমরা ঢাকা থেকে সওয়ার হলাম। শিমূল আর পীযূষ অনেক কাজ করে দিলেও গ্রাম থিয়েটারের প্রথম যাত্রায় সাথী হতে পারলেন না। যদিও পরবর্তীতে গ্রাম থিয়েটারের বিকাশে তারা বড় ভূমিকা পালন করেছিলো। পথিমধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেলিম ও পারুল আমাদের সাথে যোগ দিলো। বাস আমাদের নিয়ে আমার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সাভার- ধামরাই হয়ে মানিকগঞ্জের পথে দ্রুত চলছে। আসাদের খোলাগলায় গাণ আর সাথে শাহজাহানের ঢোলের চাটিতে বাসযাত্রা আনন্দময় হয়ে ওঠে। সেলিম উত্তেজিত এমন একটি অভিনব যাত্রা নিয়ে। আর আমি অজানা নাট্য দিগন্তে আমাদের এ রোমান্টিক যাত্রার ভবিষ্যত কল্পনা করার চেষ্টায় নিমজ্জিত হই। আমার শক্তি ও সাহস আমার মুক্তিযুদ্ধের সাহস ও অভিজ্ঞতা। আর সে সাহস দ্বিগুন হয়ে ওঠে আমারই যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যদিয়ে ছুটে চলা বাসটির দুরন্ত গতি ও ঢাকা থিয়েটারের একদল তরুণ নাট্যকর্মীর শর্তহীন নিবেদনে।
ঢাকা আরিচা মহা সড়কের বরঙ্গাইল বাস স্টপে বাস থেকে আমরা নেমে পড়ি। এখান থেকে হেঁটে যেত হবে তালুকনগর। রাস্তা নাই। ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে অথবা চাষ জমিনের উপর দিয়ে। কতটা পথ হাঁটতে হবে জানতে চাইলে পারুল জানায় দশ মাইল মত। হৈ হৈ করে দলের কর্মীরা নিজের ব্যাগ ও যারযার কষ্টিউম এবং অন্যান্য সামগ্রী মাথায় তুলে রওনা হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি টের পাই শরীরে জ্বর। কাউকে বলিনি। দশমাইল হাঁটা! শরীরের কথা ভেবে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পর এত দীর্ঘ পদযাত্রা গত দুবছরেও করিনি। যাক জয় বাংলা বলে যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমে কিছুটা পথ গ্রামের কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় ধুয়েমুছে সরু হয়ে গেছে। সে পথে আমরা হাঁটা শুরু করি।
সেলিম ও পারুল পথের জন্য মুড়ি ও গুর নিয়েছিলো সাথে। সবাই ক্ষুধার্ত কেননা ভোরে নাস্তা না করেই রওনা দিয়েছি। রাই- সরিষার তীব্র ঝাঁঝ নাকে এসে লাগে। আমরা পথের শেষে ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে থাকি। নির্মেঘ মাঘের ধূসর আকাশে দু একটি চিল ওড়ে। সেলিম এ অঞ্চলে তার গত অর্ধযুগের অভিজ্ঞতা গল্পের মত গড়গড় বলতে থাকে। যমুনার পলি মাটিতে গড়া এ অঞ্চলের ধান কেমন হয়! শাক সবজীর ব্যাপক ফলন কি করে গ্রামের প্রান্তিক মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আবার ফসল ঘরে তুলে কিভাবে, বিচার গান, কবি গান, যাত্রা হাস্তর আর গাজীর গানে মেত ওঠে সে কথাগুলো গল্পচ্ছলে বলতে থাকে। ক্লান্তবোধ করেনা দলের কেউ। কিন্তু আমার জ্বর বেড়ে যায়। ঠোঁটের জ্বরঠোসা ওঠে। মুখ ফুলে যায়। আমার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের যাত্রা, ক্ষেতের পাশে একটি ছোট্ট গ্রামে বিরতি নেয়। একইসাথে সবার চা পানি খাবার প্রয়োজনও ছিলো।
পারুলের পিতা এ অঞ্চলের একনামে পরিচিত মানুষ। পারুল এলাকার লোকদের একটি এক্কাগাড়ী জোগারের অনুরোধ করে। যেন আমি না হেঁটে এক্কা গাড়িতে যেতে পারি। অল্পসময়ে গাড়ী জোগাড় হয়। রুগ্ন লোম উঠে যাওয়া শীর্ণকায় একটি নির্লিপ্ত ঘোড়া সাদৃশ্য প্রাণীর কাঁধে গাড়ীর কাঠের জোয়াল বাঁধা। কিন্তু আমি ভাবি রাস্তা নাই গাড়ী যাবে কেমন করে। আর এই ঘোড়াটা তো পথি মধ্য প্রাণ হারাবে! আমার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। সেলিম বলে পারুল শীতকালে যখন গ্রামে আসে তখন এই এক্কা গাড়ী ভরসা। আর বর্ষায় নৌকা। উঠে পড়ো কমরেড।
আবার যাত্রা শুরু আমি ও পারুল গাড়ীতে। সেলিম আসাদ সহ সকলে পায়ে হেঁটে! এবড়ো থেবরো অসমতল ক্ষেতের উপর দিয়ে এক্কাগাড়ীর দুলুনিতে আমার নাভিশ্বাস। আমি বলি আমাকে নামিয়ে দাও আমি হেটে যাই। কখনো হেঁটে কখনো এক্কা গাড়ীর ঝক্কি সামলে আমরা যখন তালুকনগর পৌঁছাই তখন সূর্য মধ্য গগন থেকে পশ্চিমে পড়েছে। হাল্কা শীত অনুভূত হয়। সেলিমের শ্বশুর, বাড়ীর লোকজন এবং মেলা কমিটির মানুষরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে আমাদের অভ্যর্থনায়। একটা সমতল মাঠ, এককোনে একটি বিশাল অশ্বথ গাছ। পাশে একটি জীর্ণ স্কুল ঘর। আমাদের থাকার ব্যবস্থা স্কুল ঘরের একটি কক্ষে। ইতিউতি ক’টি দোকান এবং উন্মুক্ত স্থানে পসড়া নিয়ে কিছু মানুষের জটলা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক সাধারণ মানুষ ও বাউল সাধকদের দেখতে পেলাম। একটা ছোট চাঁদোয়ার নীচে একটি মাটির উঁচু স্থান দেখতে পাই। বুঝি ওটি মঞ্চ। দূরে মাঠের পাশে একটি মাজার। আজহার বয়াতীর মাজার। যাকে ঘিরে দীর্ঘকাল ধরে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মাঠের আরেক পাশে বড়বড় অনেকগুলো ডেকচিতে রান্না হচ্ছে। উনুনের ধোঁয়া শীতের ধূসর আকাশ আরো ধূসর করে দেয়।
পারুলের পিতা-মাতা জামাই অর্থাৎ সেলিম ও তার বন্ধুদের আপ্যায়নের জন্য একটি খাসী জবাই করেছে। জামাই বলে কথা। আমাদের তাড়া দেয় সেলিম দ্রুত স্নান সেরে নেবার জন্য। আর দু’জন তরুণের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। একজন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের প্রথম কর্মী মানিক। অন্যদল পারুলের অনুজ ভ্রাতা কামরুল হাসান খান। পরবর্তীতে মানিক বাংলাদেশের প্রথম সংগঠন ‘তালুকনগর থিয়েটার’র প্রধান উদ্যোক্তা এবং গ্রাম থিয়েটার’র প্রাথমিক কালের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কামরুল কিছুটা পরে গ্রাম থিয়েটারের সাংগঠনিক কাজে যোগ দেয় এবং এখনো গাম থিয়েটারে সক্রিয়।
ঐ দু’জন যুবকের সহায়তায় আমরা দ্রুত স্কুল কক্ষে ব্যাগ ও দ্রব্যাদি রেখে পুকুরে স্নান সেরে সেলিমের শ্বশুর বাড়ীতে খেতে যাই। আমন ধানের সুগন্ধ, সিম-ফুলকপির ভাজি ও লালা ঝড়ানো খাসীর মাংস দিয়ে সবাই ভরপেট খেয়ে স্কুল ঘরে ঢুকে মাটিতে বিছানো খড়ের উপর শুইয়ে পড়ি। কিছুক্ষনের মধ্য ঘুম নেমে আসে চোখে। ঘন্টা খানেক পর ঘুম ভাঙলে দেখি আমার মুখ ফুলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। সেলিমের শ্বশুর ডাক্তার নিয়ে আসে। ডাক্তার দু’টা এন্টিবায়েটিক দেয় একসাথে আর প্যারাসিটামল। স্কুল ঘর থেকে খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পাই হাজার হাজার মানুষ মেলা প্রাঙ্গনে।
দূর থেকে ঢোল কর্তালের শব্দ ও গান ভেসে আসে। আমাদের দলের সবাই বের হয়ে গেছে মেলায়। খানেকপর আমি উঠেপড়ি। শীতের সন্ধ্যা চুপ করে নেমে এসেছে। ঘণ অন্ধকারে মেলাপ্রাঙ্গন হ্যারিক্যান ও হ্যাজাকের অনুজ্জ্বল আলোয় মায়াবী হয়ে ওঠে। আমি ভারী একটা চাদর গায়ে মেলায় ঢুকে পড়ি। ছোট্ট একটা অস্থায়ী চায়ের দোকানে আসাদ ও অন্য ক’জনকে চা পান রত দেখতে পাই। আমিও এক কাপ চা নিয়ে মেলায় আগত গ্রামের প্রান্তিকভাবে মানুষদের দেখি। দারিদ্র এই মানুষের শরীর ছুঁয়েছে কিন্তু মন ছুঁতে পারেনি। সন্তান-স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে পালা দেখতে। স্বল্প অর্থে মেলা থেকে জিনিষ পত্র কিনতে। আজহার বয়াতীর মাজারে সিন্নি দিতে। ওদের কথায় জানা হয়ে যায়, সারা বছরে এই একটি মেলায় তাদের সংসারের কিনি- বিকি! এটি তাদের প্রাণের মেলা। মেলায় হাঁটতে হাঁটতে কত রকম মানুষের সাথে দেখা হয়। সেই ভারতের আসাম থেকে আসা আজহার বয়াতীর গুণ মুগ্ধ গায়েন ও অনুসারি। আর বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলের গায়েন ও মানুষেরাতো আছেই। মাঠের নানা প্রান্তে গোল হয়ে বসে সাধকরা দেহতত্ত্ব , মুরশেদী, মারফতি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। আর তখন মঞ্চে চলছে বিচার গাণ। একই সাথে রান্না করা সিন্নিও ভোগ করছে অনেকে। এ যেন এক অদ্ভুত শৃংঙ্খলার কর্ম। কোন হাঁকডাক নাই। যে যার কাজ করছে। আবার কাজ শেষে শুইয়ে পড়ছে খোলা মাঠে।
ঢাকা থিয়েটার’র নাটক সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামাল’। দ্বিতীয় প্রহরের প্রারম্ভেই। স্কুলের ভাঙ্গা ঘরে খড়ের বিছানায় বসেই আসাদ, বিলু রূপসজ্জাকার ফারুকের হাতে মেকআপ নিতে থাকে।
আমরা সবাই খুব উত্তেজনা বোধ করছি। শহরের দর্শকের সামনে নাটক করার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে কিন্তু এই একেবার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে কোন বৈদ্যুতিক আলো ছাড়া চারদিক খোলা মঞ্চে কি ভাবে নাটকটি করবো। যদিও মহড়ায় আমরা ‘চারদিকে দর্শক’ বিবেচনায় রেখেছিলাম। সেলিম একটু পর পর এসে সবার মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। সন্ধ্যারাত পার হতেই তীব্র ঠান্ডা শুরু হয়। উত্তরের শীতল হাওয়া ভাঙা বেড়া ও ফাঁকফোকড় দিয়ে ঘরে ঢুকে সকলকে শীতে জবুথবু করে ফেলে। সেলিম এসে বলে বসে থাকলে হবে না। বাইরে ঘোরাঘুরি করো। হাজার হাজার মানুষের উত্তাপ, দোকানের অনেক চুলাল উনুনের উত্তাপে তোমাদের শরীর থেকে শীত পালাবে। সবাই বেড়িয়ে পড়ে। আসাদ ও বিলু মেকআপ ও রাজা ও রাজপুত্রর ঝলমলে পোষাক পড়ে মেলার মাঠে উপস্থিত হলে একটা বড় জনস্রোত তাদের অনুসরণ করতে থাকে। অনেক দোকান দার সাধারণ মানুষ তাদের নানা রকম পিঠাপুলি,গুড়ের চনামনার ঠ্যাং ও চা দিয়ে আপ্যায়ণ করতে চায়। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। নাটকের আগেই আরেক নাট্যদৃশ্য। রাত ন’টায় ঢাকা থিয়েটার’র প্রথম গ্রাম থিয়েটার’র নাট্য নিবেদন। কয়েক হাজার মানুষের হর্ষধ্বনি ও করতালিতে মুখরিত হয়েওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। কিন্তু স্বল্প সময়ের নাটক দেখে দর্শকের প্রাণ জুড়ায় না। তারা আরো অভিনয় দেখতে চায়। কিন্তু শহুরে নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার তাদের তো সময়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নাটক বা পালা শহরে বিনোদন! আর গ্রামের মানুষের কাছে তা জীবন ও জনপদের ইতিহাস, মিথের অনিবার্য মঞ্চরূপ ও বিনোদন। সুতরাং সকল অভিনেয় গল্প বা কথকতার সমন্বিত ও সামষ্টিক ব্যাখ্যাও জরুরি। গান বা পালা শেষে তাই শেষ হয় না। আলোচনা এবং পরবর্তীতে স্মৃতিতে তা বহমান।
আমরা স্কুলঘরে গিয়ে নাটকের সকল পরিচ্ছেদ ত্যাগ করে স্বাভাবিক বসন পরে খাবারের জন্য গমন করি। এবার মেলা প্রাঙ্গনে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। তীব্রশীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা গরম আমন চালের ভাতের সাথে ফুলকপি-সবজি-ডাল দিয়ে যে পরিমাণ ভাত খাই, তা ইহ জন্মের আর খাইনি। গরম ভাতের সুগ্ধের সাথে ফুলকপি ও সীমের সতেজ গন্ধে মন ভরে যায়। সেলিম সবাইকে বিশ্রাম নিতে বলে এ কারণে যে শেষরাতে গাজীর গান হবে। ওটা অবশ্যই দেখতে হবে। ঐ গাজীর গানে আমরা যে সন্ধান করছি নিজস্ব নাট্যকাঠামো ও রীতি তা দেখা যাবে। শুইয়ে পড়ি সবাই খড়ের বিছানায়। গা হাত পা চুলকাতে থাকে ধারালো খড়ের স্পর্শে। তার সাথে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস বেড়ার ফাঁক দিয়ে তীব্র গতিতে প্রবেশ করছিলো। যাক ঠোঁটে মুখে ব্যাথা ও জ্বর নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নাই। হঠাৎ সেলিমের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। জ্বর নেমেছে। শরীর ভালো বোধ করছি।
সেলিমের সাথে মঞ্চের দিকে ছুটি। অনুজ্জ্বল আলোয় জামসা গ্রামের হাকিম আলী গায়েন নামের এক গায়েন গাজীর গানের পালাকার ‘জামাল কামালের পালা’ পরিবেশন করবেন। মেলার প্রায় সকল ক্রিয়া বন্ধ। সবাই গাজীর পালা বা গান দেখবে। আমি ও সেলিম মঞ্চ সন্নিকটে ধানের নাড়ার উপরে বসলাম। উঁচু মাটি নির্মিত একটি মঞ্চ। তার উপর একটি সামান্য উঁচু মাটির ঢিবি। সে ঢিবির সামনে গাজীর আশা (লাঠি) মঞ্চজমিনে পোঁতা। তার সামনে ধাপের ধোঁয়া ও দুর্বাঘাস ফুল। গাজীর নৈবেদ্য।
গাজীর গানের মূল গায়েন কে সহায়তা করে যে বাদন দল তাদের মধ্যে একজন ঠেটা। সেলিম আমাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। সকলের পোষাক সাধারণ কৃষকের প্রাত্যহিক পোষাক। গাজীর পড়নে নিম্নাংশ ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপি। সেলিম ব্যাখা করলো একটি অসাম্প্রদায়িক পোষাক পড়েছে গায়েন। যেন সকল ধর্মের মানুষের আস্থা পায়। তারপর গায়েন অসাধারণ কৌশলে ঢোলের দ্রগড়ের সাথে পায়ের ছন্দ মিলিয়ে এক জাদুবাস্তবার মহা ভুবনে আমাদের নিমিষে নিয়ে গেলেন। কনকনে শীতের মধ্যে বসে হাজারো দর্শক-শ্রাতা মলিন চাদরের ভিতর থেকে মুখ সামান্য বের করে অবাক বিস্ময়ে জামাল কামালের পালা দেখছে। প্রথমে মহান সৃষ্টিকর্তার নামে বন্দনা শুরু করে কাবা ঘর, গয়া কাশী, হিমালয়, ক্ষীর সাগর বন্দনা করে এক অননুকরণীয় কৌশলে জামাল কামলের কাহিনীর জট খুলতে থাকেন যে আমার অনভিজ্ঞ দৃষ্টি ও শ্রবন মূহুর্তে হাকিম আলী গায়েনের কিচ্ছার বয়ানের কাছে আত্মসমর্পন করে। সংগীত, কথা, সংলাপ, নৃত্য ও ঠ্যাটার সাথে কথা কোপনে পালা এগিয়ে যায়। দর্শকূল ব্যকুল হয়ে সেই সংগীত বয়ানের সাথে চলতে থাকে। আমরা নিদ্রাহীন চোখে গ্রামের এক অভিনেতার ঐতিহ্যবাহী নাট্যপালার পরিবেশনা দেখতে দেখতে উত্তেজিত হতে থাকি। শরীর থেকে জ্বর ও শীত খসে পড়ে।
রাতের তৃতীয় প্রহর অতিক্রান্ত। চতুর্থ প্রহরের শেষে রাতের আকাশের অন্ধকার ফিরে হয়ে আসে। জামাল কামালের সমুদ্র যাত্রার দৃশ্যে হঠাৎ করে ভোরের হাওয়া চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি হাকিম আলী গায়েন মাটির ছোট ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে ধুতির কোঁচটা খুলে বাঁ হাতে মাথার উপর তুলে ধরে। সাথে সাথে ভোরের চঞ্চল বাতাসে কোমড়ের কাছে গিঁট দেয়া অংশ থেকে বাঁ হাতের কানি আঙ্গুল দিয়ে ধরা সাদা ধুতির বিরাট অংশ সাম্পানের পালের মত ফুলে ওঠে। আর তার সাথে ঢোল কর্তালের মৃদু শব্দ, তার ছন্দময় দেহ দুলতে থাকে। এক স্বপ্নের মত দৃশ্যের অবতারণা হয়। ভোরের ফিরে আলো, হ্যাজাকের অনুজ্জ্বল আলো, বাদন ও শরীরের দুলনি, গ্রামের কাব্যভাষায় গল্প সব মিলিয়ে এক অনন্য নাট্যদৃশ্য- কাব্য আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়। এই মুহুর্তে মনে হলো আমাদের যা অনুসন্ধান তা আমরা পেয়ে গেলাম ।
সকালে নাস্তা করে স্কুলকক্ষে ঘুমাতে গেলাম। সাথে নিয়ে গেলাম একজীবনের শিল্প অর্ঘ্য। বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলে আমি ও সেলিম গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গ্রাম থিয়েটার’র প্রথম সংগঠন করা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিই। মেলা মাঠে ফিরে এসে হাকিম আলী গায়েনের সাথে তার কৃৎকৌশল নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন তার একটি মৌলিক ও প্রাথমিক গল্প কথন রীতি আছে। তবে যখন যে এলাকায় যায় সেখানকার মঞ্চ ও প্রকৃতি- পরিবেশ ও দর্শক অনুযায়ী নাট্যপ্রয়োগ বদলে যায়। তাই গতভোরে হঠাৎ বাতাস বইতে শুরু করলে তিনি ঐ অভিনয় কৌশলে পালাটি নির্মাণ করেছেন। যদি বাতাস না থাকতে তবেতো পালাটি নির্মাণ করা হতোনা। আমরা অবাক বিস্ময়ে তার কথা শুনি। নাট্যাভিনয় ও প্রয়োগের এই সীমাহীন স্বাধীনতার কথাতো আমাদের জানা ছিলোনা। হাকিম আলী গায়েনকে নিয়ে পরবর্তীতে আমরা একটি কর্মশালা করেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেলিম আল দীন, জামিল আহমেদ, আফসার আহমদ ও শিমূল ইউসুফ সেই প্রযোজনা ভিত্তিক কর্মশালার সাথে জড়িত ছিলেন। এবং জামিল আহমেদ ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটার’র হয়ে হাকিম আলী গায়েনকে দিয়ে জামাল কামালের পালা’র পরিবর্তিত রূপে প্রযোজনা ও পরিচালনার কাজটি করেছিলেন। শিমূল ইউসুফ সংগীত ও কষ্টিউমের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের প্রয়াস সেই অর্থে সফল হয়নি। বেইলী রোডের গাইড হাউসে মাত্র ৭জন ও পরবর্তীদিনে ৩জন দর্শক উপস্থিতিতে হাকিম আলী গায়েন বিষন্ন চিত্তে অভিনয়টি সেরে ছিলেন। এ আমাদের বড় লজ্জা। ঢাকার নাট্যকর্মী বন্ধুরা এবং নাট্যদর্শক এ পালাগানকে তখনো নাটক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু আমরা গায়েন চাচার কাছ থেকে আমাদের নাট্যপালার কৃৎকৌশল নিয়ে অনেক কিছু শিখেছিলাম। যা পরবর্তী নাট্যজীবনে আমাদের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় উৎসাহিত করেছিলো।
যাক সে কথা আমার শরীর বেশ ভালো বোধ করছি বিধায় দ্বিতীয় দিন তালুকনগরের সাত্তার গায়েনের ‘হাস্তর’ শোনার জন্য রয়ে গেলাম। সে আরেক অভিজ্ঞতা। পায়ে ঘুঙ্গুর বেঁধে গায়েনদল সহ হাস্তর শুরু করার পাঁচ মিনিটের মধ্য পুরো মেলা মাঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। বিচিত্র কৌশলে বেহুলা লক্ষিন্দরের বাসর ঘরের বর্ণনা ও মনসার ক্রোধ যে দ্রুতলয়ে সংগীতে নৃত্য ও কথায় শোনালেন সেও এক বিস্ময় আমাদের জন্য। তাঁর সাথেও একটি কর্মশালা করেছিলাম পরবর্তীতে পুরানা পল্টনে সময় নাট্যদলের মহড়া কক্ষে। এসবই সেই তালুকনগর যাত্রার অব্যবহিত পরে।
দু’দিন দু’রাত থেকে আমরা সকালে ঢাকায় ফিরবো। সেলিম-পারুল থেকে যাবে। প্রথম বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভা ডাকা হলো সেই স্কুল ঘরে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়। মানিককে সমন্বয়কারী করে তালুকনগর থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হলো। এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার নামে এই নতুন নাট্য আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির আলোকে ঔপনিবেশিক নাট্য চর্চার বিপরীতে দেশজ নাট্যচর্চা ও আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। তারজন্য প্রয়োজন গবেষণা এবং চর্চা। যে অনুসন্ধান মন ও তৃষ্ণা নিয়ে গমন করেছিলাম তালুকনগর সেই রতনের সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম সেলিম আল দীনের নেতৃত্বে। ফিরে আসার পথে মন ও শরীর ফুরফুরে। আমরা আমাদের শিল্প পথের সন্ধান পেয়েছি। সে পথে এখন যুথবদ্ধ এগোবার পালা। ঢাকা থিয়েটার খুব দ্রুত ফেনীর সংলাপ, বগুড়ার বগুড়া থিয়েটার, কুষ্টিয়ার বোধন ও সিলেটের সুরমা থিয়েটার কে সংগঠিত করে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার সংগঠনের জন্ম দেয়। সে আজ থেকে চল্লিশ বছর পূর্বের কথা। ১৯৮২ সালের কথা। আজ ২০২২ এর মার্চের ২০ তারিখ রবিবার। চল্লিশ বছর পর আবার ফিরে এসেছি আমাদের সেই জন্মস্থানে। যেখান থেকে একদা যাত্রা শুরু করেছিলো গ্রাম থিয়েটার। যদিও ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয়বার আমাদের আরেক যাত্রায় গিয়েছিলাম তালুকনগর। সে অন্য কথা ।
তাই বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’র চল্লিশ বছর উদযাপন করতে আমাদের আগমন তালুকনগরে। এ আগমন জন্মের ক্ষণ স্মরণ করার জন্য। এ আগমন তালুকনগরের মানুষ, শিল্পী ও সাধকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে। আপনারা আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন।
বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার হয়তো যা অর্জন করতে চেয়েছিলো তা পুরোটা অর্জিত হয়নি। কিন্তু আমরা থামিনি। আমরা চলেছি গ্রাম বাংলার পথে পথে। আমরা চলেছি ঐতিহ্য ও শিকড় অন্বিষ্ট শিল্পরথে সওয়ার হয়ে। আমার জীবদ্দশায় সেই সাফল্যের দ্বার হয়তো ছোঁয়া যাবে না কিন্তু মনে এই বিশ্বাস যে একদিন নিশ্চয়ই আমাদের উত্তর প্রজন্ম আমাদের আরধ্যকর্ম বহন করে নিয়ে যাবে সাফল্যের পথে। তখন নিশ্চিত ‘বিশ্ব মঞ্চে ঝংকৃত হবে বাংলা নাটকের শ্বাশত সুর’। একদা যেই মানুষটিকে সাথে নিয়ে বাংলার গ্রামের পথে বাঙালির শিল্পরূপ ও ইতিহাস অন্বেষণে বেরিয়েছিলাম সেই সেলিম আল দীন চৌদ্দ বছর আগে ২০০৮ এ সেই জানুয়ারি মাসেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার অনুপস্থিতিতে আমরা অসহায়। সেলিম আল দীনের চলে যাওয়ার পর চলে গেলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’র দু’জন কৃতি মানুষ, অধ্যাপক আফসার আহমদ এবং সাইদ হোসেন দুলাল। এঁদের প্রয়াণে আমরা বিপর্যস্থ। তাদের অবদান স্মরণে রেখে আমাদের পথ চলতে হবে। তাদের কর্ম আমাদের আমাদের প্রধান শক্তি। এছাড়া সারা দেশে শতাধিক গ্রাম থিয়েটার কর্মী গত চার দশকে আমাদের নিঃসঙ্গ করে চলে গেছেন। তাদের স্মৃতি আমরা কোনদিনই ভুলবোনা। তারা আমাদের কর্মে স্মরিত হন প্রতিদিন।
আর যারা আমাদের এই দীর্ঘ পথচলায় আমাদের সাথে এখনো আছেন সুখে-দুঃখে আনন্দ-বেদনায় সাফল্যে-ব্যর্থতায় তাদের জন্য উষ্ম আলিঙ্গন ও ভালোবাসা। বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার এক অবিনাশী সত্তার নাম। এর ধ্বংস নাই। গ্রাম থিয়েটার’র কাফেলা চলবে অনন্ত কাল। কেননা ‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে।’